Followers

Sunday, 14 January 2018

পৌষ - পার্ব্বণের পালা

খুব ছোটবেলায় মনে আছে চুষি বা চষি পিঠে খুব ভাল লাগত খেতে। আমাদের দোতলার কোয়ার্টারের কাকিমা বানিয়ে খাওয়াতেন। আসলে তখন নিজের বাড়ি ছাড়া অন্য সবার রান্না খেতে বেশি ভাল লাগত, বুঝতে পারতাম না কেন অন্য সবাই আমার মায়ের রান্নার সুখ্যাতি করত। বাবা অবিশ্যি মজা করে বলতেন, "ভাত রোচে না, রোচে 'ম', চিড়ে রোচে 'প' 'প'" অর্থাৎ নিজের বাড়ির দুধ পুলি, সেদ্ধ পুলি - এসব ভাল জিনিস ভাল লাগছে না, উনি যাচ্ছেন 'চষি পিঠে' খেতে!!

যারা 'চষি পিঠে' কোনদিনও খাওনি, তাদের বলি 'চষি পিঠে' হল চালের গুঁড়ি গরম জলে মেখে, প্রদীপের সলতে পাকানোর মত লেই পাকিয়ে দুধে ফোটানো। না আছে নারকোলের ব্যবহার, না আছে ক্ষীর করার ঝঞ্ঝাট। খেতে দুধ পুলি বা সেদ্ধ পুলির তুলনায় একেবারেই নস্যি।

আরও মনে পড়ে, বাড়িতে প্রায় তিনদিন ধরে পিঠে খাওয়া হত। একদিন গরম গরম সেদ্ধ পিঠে পয়রা গুড় দিয়ে, সাথে মুগ সামালি, পাটিসাপ্টা, পরের দিন গোকুল পিঠে ও রস বড়া, আর তার পরের দিন আমাদের রাঙালু খাওয়ানোর জন্য রাঙালুর পিঠে ও পায়েস, সরু চাকলি ও 'মৌ-ঝোলানি গুড়'। নারকোল নিয়ে আসা হত সু্দূর চব্বিশ পরগণার দাদুর বাড়ি অথবা মাসিদের বাড়ি থেকে, তখন দুর্গাপুরে নারকোল গাছ পাওয়া খুবই দুষ্কর ছিল আর বাজারে নারকোল ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ছিল। গুড় অবশ্য বাবা কোথা থেকে আনতেন, উনিই জানতেন, তবে সেই গুড় নানা ভাবে বহুদিন খাওয়া হত। এমন ভাবেই খাওয়া হত যাতে অনেকদিন পর্য্যন্ত খাওয়া যেত। প্রথম দিকে পয়রা গুড় যাকে জলীয় অবস্থার নলেন গুড় বলা হয়, সেটা সেদ্ধ পিঠে দিয়ে খাওয়া হত, সেই গুড়ই বাবা পরের দিকে জল দিয়ে ফুটিয়ে ফুটিয়ে খাওয়াতেন 'মৌ-ঝোলানি' গুড় বলে চালিয়ে। তখন এই কাণ্ড-কারখানায় হাসতাম, এখন বুঝতে পারি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে সখ ও সাধ্যের মেলবন্ধন ঘটানো হত এই কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে। বাবা হয়ত নিজের ছোটবেলায় যা পাননি, পারেননি,  সেটাই পেতে চাইতেন, পারতে চাইতেন।

বাবার এই পৌষ-সঙ্ক্রান্তি নিয়ে ছেলেমানুষিটাকে যোগ্য সঙ্গত করতেন আমার মা। ওপর ওপর রাগ দেখালেও, বাবা যা যা পিঠে খেতে চাইতেন, তাই  তৈরি করে খাওয়াতেন উনি। বাবা আসকে পিঠে খাওয়ারও ফরমায়েশ করতেন মাঝে মধ্যে, কিন্তু বাড়িতে মাটির সরা না থাকার দরুন মা ইডলি বানিয়ে খাওয়াতেন, মনে আছে। বাবার এই আসকে পিঠে খাওয়ার বাড়াবাড়ি নিয়ে আমরা বাবার অনুপস্থিতিতে কোনসময় হেসে উঠলে মা বলতেন বাবার ছোটবেলার পিঠে খেতে না পাওয়ার কাহিনী। অভাবের সংসারে তখন এই বচ্ছরকার দিনে ঠাকুমা আসকে পিঠেই তৈরি করতে সক্ষম ছিলেন, গুড়-নারকোল ছিল সত্যি সত্যি মহার্ঘ্য। তাই জন্যই হয়ত বাবা, সঙ্ক্রান্তির দিনে উচ্চস্তরের পিঠেদের সাথে নিজের ছোটবেলার সেই যত্ন নিয়ে স্বল্পাড়ম্বরে গড়া আসকে পিঠেকেও চেখে দেখতে চাইতেন। সেই মাটির বাড়িতে বেড়ে ওঠার সাধারণ দুঃখ দুর্দশার দিনগুলোকে তুলনামূলক সচ্ছলতার দিনগুলোর সাথে একাসনে বসাতে চাইতেন, হয়ত বা।

সেই বেড়ে ওঠার দিনগুলোয়, কেন জানিনা, এই সম্বৎসরের পিঠে - উৎসব আমার কোনমতেই ভাল লাগত না। মানুষ বোধহয় সহজে যা পায়, তাকেই হেলাফেলা করে। আমারও ছিল তাই অবস্থা। বাংলার পৌষ-পার্ব্বণের অভাব প্রথম বোধ করতে শুরু করি যখন চাকরিসুত্রে ঝাড়খণ্ডে থাকতে শুরু করি। মনে আছে, সেবার, যখন পৌষ-সঙ্ক্রান্তির পর কোন এক দীর্ঘ ছুটিতে কলকাতায় এসেছিলাম, মাকে বলেছিলাম পিঠে করে খাওয়াতে। পরম মমতায় স্পর্শ করেছিলাম উষ্ণ সেদ্ধ পিঠেগুলোকে, খেতে খেতে এক লহমায় যেন পৌঁছে গেছিলাম দুর্গাপুরের কোন এক পৌষের সন্ধেতে।

না ফেরার দেশে পারি দেওয়ার আগেও মা খাইয়েছিলেন রাঙালুর ভাজা পুলির পায়েস ও নতুন গুড়ের পায়েস। পিঠে গড়ার পাঠও দিতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু, নিতান্ত আলসেমি ও স্বল্প ধৈর্য্যের জন্য আমি কোনদিনও শিখে নেবার চেষ্টাই করিনি। মন ভেবেছিল, মা তো আছেই, আর শেখার কি দরকার? তখন যদি মন জানত যে মায়ের যাবার সময় হয়ে গেছে, তাহলে হয়ত শিখে নিতাম, নিশ্চই শিখে নিতাম।

Sunday, 7 January 2018

স্মৃতির বাগান

দূর্গাপুরের এম এ এম সি টাউনশিপের অন্তর্গত বি-ওয়ান ১০৭/২ কোয়ার্টারের ছড়ানো বাগানে তখন অবাধ বিচরণ করা যেত। আম, কাঁঠাল, পেঁপে, পেয়ারার গাছেরা ছিল বন্ধু গাছ। শত্রু গাছ ও ছিল, - বাসক পাতার গাছ - ঘনঘন ঠাণ্ডা লাগার কারণে গিলতে হত তেতো পাঁচন। উপরোনোর চেষ্টা চলেছিল পুরোদমে - কিন্তু ছোট ছোট হাতের জোর কে সে অবজ্ঞা করে বেড়ে চলছিল।শীতকালে কিছু মরশুমি ফুলের দল আসত পরিযায়ী পাখিদের মত। আর পাখী - নাঃ শালিখ ছাড়া আর কিছু মন দিয়ে খোঁজা হয়নি তখন।

একদিন সেই বাগানে এক অশীতিপর বৃদ্ধ মালী - সন্তোষ কাকুর আবির্ভাব হল। বাগানটাই বেবাক বদলে গেল। সজনে গাছের ওই পারে আলু, পালং শাক, মেথি শাক বোনা শুরু হল, বেগুন, টমেটো ও কাঁচালঙ্কাও লাগানো হল। কিন্তু সেই ক্ষেতের আলের ওপর দিয়ে হাঁটতে ভয় করত - কি জানি কোন শাকটার ব্যাথা লেগে যায়। বাগান টা ছিল সন্তোষ কাকুর প্রাণ। সারাদিন খাটতে পারতেন আর বেলা পড়ে এলে দিতেন গাছের সারের হদিশ। বাবা মা যখন ওঁর সাথে একসাথে চা খেতে খেতে ওঁর সাথে গাছ নিয়ে আড্ডা মারতেন আর সময় পেলেই ওঁর সাথে গাছের পরিচর্যা করতে লেগে যেতেন, খুব মজা হত - শ্রেণীসমতার সেই প্রথম পাঠ - হাতেকলমে। ...

বাবা মায়ের ষ্টীলের চায়ের কাপের ধূমায়িত চায়ের কোন ভাগ ছিল না, ভাগ ছিল টায়ের চানাচুর ও মুড়িমাখায়। আর, আর ভাগ ছিল গল্পের, আলোচনায়। অধিকার ছিল মতামত দেওয়ার ও শোনার। আধ ঘণ্টার চা পানে হঠাৎ বড় হয়ে যাবার একটা আকর্ষন।

চা পানেরও অধিকার যখন পাওয়া গেল, তখন বদলে গেল বাসস্থান। আরেকটা কোয়ার্টার, - সি ডি ১১১/১। মা চেয়েছিল বাগান করার বিস্তর যায়গা আর আলো হাওয়ার অবাধ যাতায়াত, তাই বাছা হল এই কোয়ার্টার। তাও পুরোনো কোয়ার্টারের মায়া কাটানো গেল না। নতুন বাসস্থানের বাগানে ছিল কাঁকর, বালি ও সিমেন্টের অবশেষ। কেউ বা কারা যেন বেছে বেছে এই যায়গাটাতেই সিমেণ্টের মশলা তৈরি করত, তারা আসার আগে। অশীতিপর সন্তোষ কাকু তখন নবতিপর। হাতের জোর কমে গেলেও মনে কঠিন সঙ্কল্প, - বাগানটিকে আবার মনের মত করে তুলবেন। মনের মত বাগানে যখন ফুল ও সবজি ফলতে শুরু করলো, তিনি বাগানের মায়া কাটিয়ে পাড়ি দিলেন না ফেরার দেশে।

আরও আরও পরে সেই বাগান আর বাগান থাকে না। অনেককাল পরে যখন যাওয়া হল তখন সেই বাগানে আগাছার বন। গবাদি পশুদের নন্দনকানন। সেই বাড়ির বাসিন্দারা সেই ছোট্ট শহরের স্মৃতি বুকে জমিয়ে রেখে বড় শহরে পাড়ি দিয়েছিল অনেকবছর আগে - আরও বড় হওয়ার তাগিদে। তারা বড় হয়েও শিকড় জমিয়ে রাখল সেই  ১০৭/২ তেই। আরও বড় বাগান, আরও বড় বপুর ১১১/১ তাদের মন জয় করতে পারেনি, পারবেও না কোনদিন। তবে ১১১/১ রেখে দেবে তাদের বড় হবার স্বপ্নদের, আশাদের, আকাঙ্খাদের।