খুব ছোটবেলায় মনে আছে চুষি বা চষি পিঠে খুব ভাল লাগত খেতে। আমাদের দোতলার কোয়ার্টারের কাকিমা বানিয়ে খাওয়াতেন। আসলে তখন নিজের বাড়ি ছাড়া অন্য সবার রান্না খেতে বেশি ভাল লাগত, বুঝতে পারতাম না কেন অন্য সবাই আমার মায়ের রান্নার সুখ্যাতি করত। বাবা অবিশ্যি মজা করে বলতেন, "ভাত রোচে না, রোচে 'ম', চিড়ে রোচে 'প' 'প'" অর্থাৎ নিজের বাড়ির দুধ পুলি, সেদ্ধ পুলি - এসব ভাল জিনিস ভাল লাগছে না, উনি যাচ্ছেন 'চষি পিঠে' খেতে!!
যারা 'চষি পিঠে' কোনদিনও খাওনি, তাদের বলি 'চষি পিঠে' হল চালের গুঁড়ি গরম জলে মেখে, প্রদীপের সলতে পাকানোর মত লেই পাকিয়ে দুধে ফোটানো। না আছে নারকোলের ব্যবহার, না আছে ক্ষীর করার ঝঞ্ঝাট। খেতে দুধ পুলি বা সেদ্ধ পুলির তুলনায় একেবারেই নস্যি।
আরও মনে পড়ে, বাড়িতে প্রায় তিনদিন ধরে পিঠে খাওয়া হত। একদিন গরম গরম সেদ্ধ পিঠে পয়রা গুড় দিয়ে, সাথে মুগ সামালি, পাটিসাপ্টা, পরের দিন গোকুল পিঠে ও রস বড়া, আর তার পরের দিন আমাদের রাঙালু খাওয়ানোর জন্য রাঙালুর পিঠে ও পায়েস, সরু চাকলি ও 'মৌ-ঝোলানি গুড়'। নারকোল নিয়ে আসা হত সু্দূর চব্বিশ পরগণার দাদুর বাড়ি অথবা মাসিদের বাড়ি থেকে, তখন দুর্গাপুরে নারকোল গাছ পাওয়া খুবই দুষ্কর ছিল আর বাজারে নারকোল ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ছিল। গুড় অবশ্য বাবা কোথা থেকে আনতেন, উনিই জানতেন, তবে সেই গুড় নানা ভাবে বহুদিন খাওয়া হত। এমন ভাবেই খাওয়া হত যাতে অনেকদিন পর্য্যন্ত খাওয়া যেত। প্রথম দিকে পয়রা গুড় যাকে জলীয় অবস্থার নলেন গুড় বলা হয়, সেটা সেদ্ধ পিঠে দিয়ে খাওয়া হত, সেই গুড়ই বাবা পরের দিকে জল দিয়ে ফুটিয়ে ফুটিয়ে খাওয়াতেন 'মৌ-ঝোলানি' গুড় বলে চালিয়ে। তখন এই কাণ্ড-কারখানায় হাসতাম, এখন বুঝতে পারি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে সখ ও সাধ্যের মেলবন্ধন ঘটানো হত এই কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে। বাবা হয়ত নিজের ছোটবেলায় যা পাননি, পারেননি, সেটাই পেতে চাইতেন, পারতে চাইতেন।
বাবার এই পৌষ-সঙ্ক্রান্তি নিয়ে ছেলেমানুষিটাকে যোগ্য সঙ্গত করতেন আমার মা। ওপর ওপর রাগ দেখালেও, বাবা যা যা পিঠে খেতে চাইতেন, তাই তৈরি করে খাওয়াতেন উনি। বাবা আসকে পিঠে খাওয়ারও ফরমায়েশ করতেন মাঝে মধ্যে, কিন্তু বাড়িতে মাটির সরা না থাকার দরুন মা ইডলি বানিয়ে খাওয়াতেন, মনে আছে। বাবার এই আসকে পিঠে খাওয়ার বাড়াবাড়ি নিয়ে আমরা বাবার অনুপস্থিতিতে কোনসময় হেসে উঠলে মা বলতেন বাবার ছোটবেলার পিঠে খেতে না পাওয়ার কাহিনী। অভাবের সংসারে তখন এই বচ্ছরকার দিনে ঠাকুমা আসকে পিঠেই তৈরি করতে সক্ষম ছিলেন, গুড়-নারকোল ছিল সত্যি সত্যি মহার্ঘ্য। তাই জন্যই হয়ত বাবা, সঙ্ক্রান্তির দিনে উচ্চস্তরের পিঠেদের সাথে নিজের ছোটবেলার সেই যত্ন নিয়ে স্বল্পাড়ম্বরে গড়া আসকে পিঠেকেও চেখে দেখতে চাইতেন। সেই মাটির বাড়িতে বেড়ে ওঠার সাধারণ দুঃখ দুর্দশার দিনগুলোকে তুলনামূলক সচ্ছলতার দিনগুলোর সাথে একাসনে বসাতে চাইতেন, হয়ত বা।
সেই বেড়ে ওঠার দিনগুলোয়, কেন জানিনা, এই সম্বৎসরের পিঠে - উৎসব আমার কোনমতেই ভাল লাগত না। মানুষ বোধহয় সহজে যা পায়, তাকেই হেলাফেলা করে। আমারও ছিল তাই অবস্থা। বাংলার পৌষ-পার্ব্বণের অভাব প্রথম বোধ করতে শুরু করি যখন চাকরিসুত্রে ঝাড়খণ্ডে থাকতে শুরু করি। মনে আছে, সেবার, যখন পৌষ-সঙ্ক্রান্তির পর কোন এক দীর্ঘ ছুটিতে কলকাতায় এসেছিলাম, মাকে বলেছিলাম পিঠে করে খাওয়াতে। পরম মমতায় স্পর্শ করেছিলাম উষ্ণ সেদ্ধ পিঠেগুলোকে, খেতে খেতে এক লহমায় যেন পৌঁছে গেছিলাম দুর্গাপুরের কোন এক পৌষের সন্ধেতে।
না ফেরার দেশে পারি দেওয়ার আগেও মা খাইয়েছিলেন রাঙালুর ভাজা পুলির পায়েস ও নতুন গুড়ের পায়েস। পিঠে গড়ার পাঠও দিতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু, নিতান্ত আলসেমি ও স্বল্প ধৈর্য্যের জন্য আমি কোনদিনও শিখে নেবার চেষ্টাই করিনি। মন ভেবেছিল, মা তো আছেই, আর শেখার কি দরকার? তখন যদি মন জানত যে মায়ের যাবার সময় হয়ে গেছে, তাহলে হয়ত শিখে নিতাম, নিশ্চই শিখে নিতাম।
যারা 'চষি পিঠে' কোনদিনও খাওনি, তাদের বলি 'চষি পিঠে' হল চালের গুঁড়ি গরম জলে মেখে, প্রদীপের সলতে পাকানোর মত লেই পাকিয়ে দুধে ফোটানো। না আছে নারকোলের ব্যবহার, না আছে ক্ষীর করার ঝঞ্ঝাট। খেতে দুধ পুলি বা সেদ্ধ পুলির তুলনায় একেবারেই নস্যি।
আরও মনে পড়ে, বাড়িতে প্রায় তিনদিন ধরে পিঠে খাওয়া হত। একদিন গরম গরম সেদ্ধ পিঠে পয়রা গুড় দিয়ে, সাথে মুগ সামালি, পাটিসাপ্টা, পরের দিন গোকুল পিঠে ও রস বড়া, আর তার পরের দিন আমাদের রাঙালু খাওয়ানোর জন্য রাঙালুর পিঠে ও পায়েস, সরু চাকলি ও 'মৌ-ঝোলানি গুড়'। নারকোল নিয়ে আসা হত সু্দূর চব্বিশ পরগণার দাদুর বাড়ি অথবা মাসিদের বাড়ি থেকে, তখন দুর্গাপুরে নারকোল গাছ পাওয়া খুবই দুষ্কর ছিল আর বাজারে নারকোল ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ছিল। গুড় অবশ্য বাবা কোথা থেকে আনতেন, উনিই জানতেন, তবে সেই গুড় নানা ভাবে বহুদিন খাওয়া হত। এমন ভাবেই খাওয়া হত যাতে অনেকদিন পর্য্যন্ত খাওয়া যেত। প্রথম দিকে পয়রা গুড় যাকে জলীয় অবস্থার নলেন গুড় বলা হয়, সেটা সেদ্ধ পিঠে দিয়ে খাওয়া হত, সেই গুড়ই বাবা পরের দিকে জল দিয়ে ফুটিয়ে ফুটিয়ে খাওয়াতেন 'মৌ-ঝোলানি' গুড় বলে চালিয়ে। তখন এই কাণ্ড-কারখানায় হাসতাম, এখন বুঝতে পারি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে সখ ও সাধ্যের মেলবন্ধন ঘটানো হত এই কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে। বাবা হয়ত নিজের ছোটবেলায় যা পাননি, পারেননি, সেটাই পেতে চাইতেন, পারতে চাইতেন।
বাবার এই পৌষ-সঙ্ক্রান্তি নিয়ে ছেলেমানুষিটাকে যোগ্য সঙ্গত করতেন আমার মা। ওপর ওপর রাগ দেখালেও, বাবা যা যা পিঠে খেতে চাইতেন, তাই তৈরি করে খাওয়াতেন উনি। বাবা আসকে পিঠে খাওয়ারও ফরমায়েশ করতেন মাঝে মধ্যে, কিন্তু বাড়িতে মাটির সরা না থাকার দরুন মা ইডলি বানিয়ে খাওয়াতেন, মনে আছে। বাবার এই আসকে পিঠে খাওয়ার বাড়াবাড়ি নিয়ে আমরা বাবার অনুপস্থিতিতে কোনসময় হেসে উঠলে মা বলতেন বাবার ছোটবেলার পিঠে খেতে না পাওয়ার কাহিনী। অভাবের সংসারে তখন এই বচ্ছরকার দিনে ঠাকুমা আসকে পিঠেই তৈরি করতে সক্ষম ছিলেন, গুড়-নারকোল ছিল সত্যি সত্যি মহার্ঘ্য। তাই জন্যই হয়ত বাবা, সঙ্ক্রান্তির দিনে উচ্চস্তরের পিঠেদের সাথে নিজের ছোটবেলার সেই যত্ন নিয়ে স্বল্পাড়ম্বরে গড়া আসকে পিঠেকেও চেখে দেখতে চাইতেন। সেই মাটির বাড়িতে বেড়ে ওঠার সাধারণ দুঃখ দুর্দশার দিনগুলোকে তুলনামূলক সচ্ছলতার দিনগুলোর সাথে একাসনে বসাতে চাইতেন, হয়ত বা।
সেই বেড়ে ওঠার দিনগুলোয়, কেন জানিনা, এই সম্বৎসরের পিঠে - উৎসব আমার কোনমতেই ভাল লাগত না। মানুষ বোধহয় সহজে যা পায়, তাকেই হেলাফেলা করে। আমারও ছিল তাই অবস্থা। বাংলার পৌষ-পার্ব্বণের অভাব প্রথম বোধ করতে শুরু করি যখন চাকরিসুত্রে ঝাড়খণ্ডে থাকতে শুরু করি। মনে আছে, সেবার, যখন পৌষ-সঙ্ক্রান্তির পর কোন এক দীর্ঘ ছুটিতে কলকাতায় এসেছিলাম, মাকে বলেছিলাম পিঠে করে খাওয়াতে। পরম মমতায় স্পর্শ করেছিলাম উষ্ণ সেদ্ধ পিঠেগুলোকে, খেতে খেতে এক লহমায় যেন পৌঁছে গেছিলাম দুর্গাপুরের কোন এক পৌষের সন্ধেতে।
না ফেরার দেশে পারি দেওয়ার আগেও মা খাইয়েছিলেন রাঙালুর ভাজা পুলির পায়েস ও নতুন গুড়ের পায়েস। পিঠে গড়ার পাঠও দিতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু, নিতান্ত আলসেমি ও স্বল্প ধৈর্য্যের জন্য আমি কোনদিনও শিখে নেবার চেষ্টাই করিনি। মন ভেবেছিল, মা তো আছেই, আর শেখার কি দরকার? তখন যদি মন জানত যে মায়ের যাবার সময় হয়ে গেছে, তাহলে হয়ত শিখে নিতাম, নিশ্চই শিখে নিতাম।
No comments:
Post a Comment