Followers

Monday 6 November 2017

মুরগী কাকুর বাগান
তাঁর নামটি ছিল আর এস মুখার্জী। নামের আগে একটি উপাধি ছিল। ডাক্তার। অথচ ওঁরই কিনা নাম হয়ে গেল মুরগী মুখার্জী! আমরা যারা একই পাড়ায় থাকতাম, তারা ছাড়াও অন্য পাড়ার অধিবাসীরা তাঁকে চিনতেন এই জনপ্রিয় নামটিতে। এরকম অদ্ভুত নামকরণ কে বা কারা করেছিল জানা নেই তবে নামের নেপথ্যে ছিল ওঁর বাগানে চাষ করা মুরগীরা। কোন এক রাতদুপুরে মুখার্জী কাকুর বাড়িতে চোরেরা অথবা কিছু উঠতি চ্যাংড়া ছেলেপুলে বাগান থেকে মুরগী চুরি করে রান্না করে এবং পরের দিন ভোরবেলায় এই কাণ্ড দেখে উনি যারপরনাই বিলাপ করতে থাকেন। সেই থেকে ওঁর নামে মুরগী জুড়ে গেছিল। এই অবধি পড়ে যাঁরা ভাবছেন যে ছেলেগুলো তো বড়ই উচ্ছৃঙ্খল, এরকম একটা ক্ষতি করল, তাঁদের বলব একটু ধৈর্য ধরে পুরোটা পড়তে।
তা, এই উঠতি যুবকবৃন্দের দোষ বিশেষ ছিল না। কাকু কাউকেই নিজের বাগানের ধারেপাশে ঘেঁশতে দিতেন না। বাগানের বাতাবি লেবুর গাছ, ফুল গাছ, সজনে গাছ দের কে সযত্নে লালন পালন করতেন এবং জীবন্ত যক হয়ে আগলে রাখতেন। পাড়ার কেউই সেই ফলনের ভাগ পেতাম না। পাড়ার ছেলেরা ক্রিকেট বা ফুটবলের বল ওনার বাগানে পড়ে গেলে যদিও বা ভাবত যে লেবুটা বা আমটা বা পেয়ারাটা জামার ভিতরে চালান করবে, তা ভাবনার স্তরেই থেকে যেত, কখনও সখনও বলগুলোও থেকে যেত গাছেদের সাথে। একেবারে বইয়ের পাতার সেই সেলফিশ জায়ান্ট। আমগাছের কথা বলিনি এখনও, না? আমার মা বলতেন, মুরগী কাকু, কায়দা করে আমাদের বাগানের একেবারে ধারের দিকের আমগাছটি আপন করে নিয়েছিলেন, বেড়ার এদিক ওদিক করে। হ্যাঁ উনি আমাদের ঠিক পাশের কোয়ার্টারেই থাকতেন। আমাদের বাগানে আরও তিনটি আমগাছ ছিল এবং এই চারটে গাছই আমার ঠাকুরদার হাতে লাগানো গাছ ছিল। আমের সময়ে, মনে পড়ে আমাদের পুরো পাড়ার সবাই আমাদের গাছের আম খেতেন। ঝড়ের সময় অনেকেই চলে আসতেন আম কুড়োতে। আবার অনেকে ঝড়ের পরে দরজা খুলে অপেক্ষা করতেন আমি বা দাদা আম নিয়ে যাব বলে। মুরগী কাকু অবশ্যই আমাদের আমের ভাগ দিতেন না আর আমরাও ওঁর বাড়ি আম নিয়ে যেতাম না।
একবার ওঁর বাগানের আম গাছটিতে অনেক বোল ধরেছিল। উনি তখন ঝাঁটা ও পুরোনো বুট জুতো গাছে ঝুলিয়ে দেন, সম্ভবত নজর না লাগার পাকা ব্যবস্থা করেছিলেন। সেবছর হল কি, বেশ অনেক্ষণ ধরে কালবৈশাখীর ঝড় চলল। আমি, মা ও দাদা ঝড়ের মধ্যেই টপাটপ আম কুড়োচ্ছি এবং খালি ব্যাগ বস্তা যা পাচ্ছি তার মধ্যে জমিয়ে রাখছি, এমন সময় দেখি হাওয়ার তোড়ে, কাকুর গাছের ঝাঁটা-জুতো সুদ্ধু আমেরা আমাদের বাগানে এসে দেহ রাখছে। আনন্দের সীমা রইল না। চাল রাখার খালি বস্তা নিয়ে এসে আমি ও দাদা দ্বিগুন উৎসাহে আম কুড়োতে শুরু করলাম। ঝড় থামার সময়ে কাকু ব্যাগ ও বস্তা নিয়ে হতোদ্যম হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ সুরেলা গলায় আমাকে ডেকে অনুরোধ করতে লাগলেন কয়েকটা আম ওনাকে দিতে। আমরা তো কিছুতেই কোন অনুরোধে কান দেব না ঠিকই করে রেখে ছিলাম। একে টেক্নিকালি আমাদের ঠাকুরদার লাগানো গাছ তার ওপর আবার প্রচুর ফলন। হঠাৎ বিপ্লবী হয়ে উঠেছিলাম দুই ভাইবোনে। মা আমাদের চোখে চোখে অনুরোধও করলেন, কিন্তু আমরা পাত্তা দিলাম না মোটেই। বাবা পুরো ঘটনাটাই জানালা দিয়ে চুপি চুপি লক্ষ্য করেছিলেন। এহেন বিপ্লবীদের দমন করা প্রয়োজন মনে করে সেবার বাবা আমাদের তীব্র ভর্ৎসনা করে নিজে গিয়ে ওনাকে কিছু আম দিয়ে এসেছিলেন।
এই ঘটনার পর মুরগী কাকু একটু যেন বদলে যান। ডেকে ডেকে সজনে ডাঁটা দিতেন, বাতাবী লেবু বা এঁচর দিতেন। হেসে কথা বলতেন। আমরা ওই কোয়ার্টার ছেড়ে দেওয়ার দিন পর্য্যন্ত এই সৌজন্যবোধ বজায় ছিল। এর বেশ কিছু বছর পরে শুনলাম কাকু মারা গেছেন। মনটা বিষাদে ভরে উঠেছিল। মনে হয়েছিল একটুকরো বর্ণময় ছোটবেলাটা যেন কোথায় ভিনদেশে মুরগীকাকুর সাথে পাড়ি দিয়ে দিয়েছে।

No comments:

Post a Comment